কে.এম. নাছির উদ্দিন

এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গনের এক পরিচিত মুখ মরহুম আলহাজ্ব মাহমুদুল করিম চৌধুরী ২৭ ডিসেম্বর তাঁর ১২ তম মৃত্যু বার্ষিকী। দীর্ঘদিন কিডনি রোগে ভোগার পর ২০০৫ সালের এ দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। মানুষে-মানুষে সহমর্মিতা সৃষ্টির যে মহৎ শিল্প কর্ম, তার নাম রাজনীতি আর এ শিল্পের যিনি নিপূণ শিল্পি, তারই নাম রাজনীতিবিদ। রাজনীতি নামক এ মহৎ শিল্প কর্মের খাতায় তিনি নাম লিখিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ক্রীড়া সংসদ সম্পাদক থাকা কালে। মজলুম জননেতা মরহুম আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানীই তাঁর রাজনীতি গুরু, পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন তাঁর নেতা।

১৯৭৩ সালে অ-বিভক্ত চকরিয়া থানাধীন বৃহত্তর মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর গণ প্রতিনিধিত্ব জীবন শুরু। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সদস্য, বিএনপি’র কেন্দীয় ভাইস-চেয়ারম্যান ও জাতীয় মৎস্যজীবি সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি। জনাব চৌধুরী ১৯৭৯ সালে অনুষ্টিত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২য় নির্বাচনে তৎকালীন চকরিয়া- কুতুবদিয়া আসন হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হন। জমিদার পরিবারের সন্তান হিসেবে আজীবন ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসে মগ্ন থেকে সমাজে নিজের কর্ম পরিধি খুবই সীমিত রেখে আয়ুস্কাল পার করে দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্বেও তিনি ছিলেন এক জনহিতকর ব্যক্তিত্ব।

জনাব চৌধুরী সর্বশেষ ১৯৯১ সালে অনুষ্টিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। দীর্ঘ সামরিক শাসনের হাত থেকে গণ আন্দোলনে দেশ মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর অনুষ্টিত এ নির্বাচনে অঢেল অর্থের ছড়াছড়ির অসম প্রতিযোগিতায় তিনি পরাজিত হন। রাজনীতিতে সারা জীবনের ত্যাগের পরেও নিছক অর্থের আধিপত্যের করুণ দশা দেখে নিজেকে অনেকটা অ- ঘোষিতভাবে দলীয় কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে রাখেন। সকল দলের মতের মানুষের সাথে সু- সম্পর্ক বজায় রাখতে পারঙ্গম একজন দলীয় নেতাই হয়ে ওঠেন, পরিপূর্ণ জননেতা হিসেবে। একথাটি মনে প্রাণে বিশ্বাস ও চর্চা করতেন তিনি।

এ জন্য তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছেও খুব প্রিয় ছিলেন। জনগণের কল্যাণ সাধন, জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন ও জনসেবার মত শ্রুতি মধুর কথা বলে জনগণের নেতা নির্বাচিত হয়ে, তার বিপরীতে কাজ করে নিজের আখের গোছানের যে অপসংস্কৃতি দ্বারা সবসময় সরকার ও বিরোধী দলের কতিপয় অতি লোভি নেতা প্রভাবিত হন, তার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। যার কারণে সুরম্য প্রসাদের পরিবর্তে তিনি গ্রামে বসবাস করতেন পৈত্রিক জমিদারীতে বাঁশের বেড়ায় নির্মিত বাড়ীতে। আর সন্তান- সন্ততিদের লেখা- পড়ার সুবিধার্থে চট্টগ্রামে অবস্থান করতেন ভাড়া বাসায়।

তিনি ১৯৯৭ সালে চকরিয়া পুরাতন বিমান বন্দরস্থ বিজয় মঞ্চে অনুষ্টিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন- “দীর্ঘ দিনেও বাংলাদেশ, ভারত থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সক্ষম না- হলেও সদ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আগত আওয়ামীলীগ সরকার এ বিষয়ে ভারতের সাথে অন্তত একটি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়েছে, এতে ভবিষ্যতে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের পথ সুগম হয়েছে- এজন্য আমি সরকারকে অভিনন্দন জানাই।” এটি চকরিয়ার মাটিতে তাঁর জীবদ্দশায় শেষ বক্তব্য।

এ ময়দানে তিনি আরেকবার এসেছিলেন ৫ জুন ২০০১ সালে, বয়সে তাঁর সমসাময়িক বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জাতীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মরহুম আলহাজ্ব এস. কে. শামসুল হুদার নামাজে জানাযায়। একই ময়দানে জনাব চৌধুরীর মরদেহ আনা হয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর-০৫ সালে।

কিন্তু তাঁর মৃত্যু থেকে আজ অব্দি যে বিষয়টি সচেতন মহলের কাছে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে, তাহল এত বড় মাপের একজন জননেতার স্মরণে এ মাটিতে একটি স্মরণ সভা আয়োজনের জন্যও কারো প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।

অথচ দূর্গম রাজাখালীর কিছু মানুষ যারা কোনদিন রাজনৈতিক দলে বড় ধরণের কোন পদ অলংকৃত করার আশাও করেননি, সেরকম কিছু মানুষ সেখানে এবং জীবন- জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রামে বসবাসকারী চকরিয়া-পেকুয়াবাসী একটি স্মরণ সভা আয়োজন করেছিলেন। তাঁর শারীরিক চরম অসুস্থতা কালীন সময়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল-নোমান, কর্ণেল (অবঃ) অলি আহামদ সহ বিএনপি’র প্রবীণ নেতৃবৃন্দ। ২৭ ডিসেম্বর-০৫ দুপুরে চকরিয়ায় যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়, তখন এলাকার অনেক প্রবীণ মানুষের মুখ থেকে একটি মন্তব্য উচ্চারিত হতে দেখা গেছে যে- “মরহুম চৌধুরী একজন ভালো মানুষ ছিলেন”। চট্টগ্রাম, চকরিয়া ও মগনামায় ৩ দফা নামাজে জানাযা শেষে রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় তাঁর পরিবারিক গোরস্থানে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

এ নামাজে জানাযায় সাবেক যোগাযোগ প্রতি-মন্ত্রী সালাহ্ উদ্দিন আহমদ, কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সহ প্রসাশনের বিভিন্ন কর্মকর্তাবৃন্দ, তাঁর একদার নির্বচনী প্রতিদ্বন্ধি ও প্রতিবেশী এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমদ সি. আই. পি. সহ সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন।

জনাব চৌধুরী রাজনীতিতে যে আদর্শ চর্চা করতেন- বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবিদগণ সে আদর্শের কাছে এসে এখনো পৌঁছতে পারেননি- একমাত্র নিজেদের সদিচ্ছাই সম্ভব তাঁর মত একজন সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে ওঠা এবং এটিই সবচেয় বেশী প্রয়োজন। কারণ এ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের সামনে দেশ-জাতীর কাজ করার পথ আরো অনেক। এ পথ নিস্কন্টকভাবে পাড়ি দিয়ে নিজেকে একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্টায় মরহুম চৌধুরীর নির্লোভ, নিরহংকারী চরিত্র এবং পরোপকারী গুণাবলী চর্চার বিকল্প নেই।

জনাব চৌধুরীর জ্যেষ্ট পুত্র শাফায়াত আজিজ রাজু বিপুল ভোটে বর্তমানে পেকুয়া উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়ীত্ব পালন করেছেন। তাঁর নির্বাচিত হওয়ার নেপথ্যে পিতার ভাবমুর্তিও কাজ করেছে।

তিনি তাঁর পিতাকে অণুসরণ করে রাজণীতির ভবিষ্যৎ পথ পাড়ি দিতে পারলে তাঁর পিতার ন্যায় তিনিও মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকার একটি পথ সৃষ্টি করতে পারবেন। মরহুম চৌধুরী সাহেবকে আল্লাহ্ জান্নাত দান করুন।এ মুহুর্তেই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এটিই প্রার্থনা।